একদিকে হরতালসহ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা এবং অন্যদিকে ছাত্র-জনতার উপর হামলা; বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিশেষ অভিযান চলবে নারায়ণগঞ্জ জেলায়ও। এ বিষয়ে শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জেলা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, শনিবার মধ্যরাত থেকেই নারায়ণগঞ্জে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হবে। এ অভিযানকে ঘিরে ইতোমধ্যে জেলা পুলিশের প্রস্তুতি রয়েছে। অভিযানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ অংশ নেবে।
জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার মুঠোফোনে বলেন, ‘সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য চিঠি এসেছে। এ বিষয়ে আমাদের মিটিংও হয়েছে। অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত এখনই ডিসক্লোজ করবো না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যেই এ অভিযান পরিচালিত হবে।’
এদিকে, জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন হওয়া আওয়ামী লীগের কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরির কোনো পরিকল্পনা করছেন কিনা, করে থাকলে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। একইসাথে জুলাই অভ্যুত্থানে ‘গণহত্যার’ সাথে জড়িত অনেকেই দেশে আত্মগোপনে আছেন, যারা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া, সারাদেশে ‘মব ভায়োলেন্স’ রুখে দেওয়াও এই কার্যক্রমের অংশ।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের সহিংস পদক্ষেপ দলটিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালান দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা। পরে শিক্ষার্থী-জনতার সমর্থনে বাংলাদেশে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে অবস্থান করলেও আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে হরতালসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করে। জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালীন হাজারো মানুষের হতাহতের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত শেখ হাসিনা গত ৫ ফেব্রুয়ারি ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখার ঘোষণা দিলে ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে দেশের মানুষজন। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই রাতে হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্দ লোকজন। পরের দুইদিনও সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতা চলে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত, জেলা প্রশাসক এবং জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকটি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য ভাঙচুর করেন বিএনপিন্থী আইনজীবীরা। বিক্ষুব্দ আইনজীবীদের নেতৃত্ব দেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্যসচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু।
তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচতলার ‘বঙ্গবন্ধু কর্নারটিও’ ভাঙচুর করেন। সেখানে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও ফটোফ্রেম ভেঙে ফেলেন।
পরে সন্ধ্যায় মহানগর বিএনপি শহরের মিশনপাড়া এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি চাষাঢ়া এসে বায়তুল আমান নামে পুরোনো একটি ভবনের সামনে থামে। এ ভবনটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ‘গডফাদার’ তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দাদাবাড়ি। পরে বিক্ষুব্দ লোকজন ভবনের ভেতর ঢুকে সেটি এক্সাভেটর দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। এই সময় বাইরে বিএনপি নেতা-কর্মী ও উৎসুক জনতাকে আওয়ামী লীগ ও শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগানে উল্লাস করতে দেখা যায়।
ঘটনাস্থলে থাকা বিএনপি নেতা আবু আল ইউসুফ খান টিপু ওই সময় বলেন, বায়তুল আমান ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর গুম, খুন, চাঁদাবাজি ও লাটতরাজের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ ঘটেছে।
এদিকে, শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার উপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিলও করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।
এদিকে, সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং গণহত্যায় জড়িত সন্ত্রাসী ও নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে শনিবার বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অভিযানের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
‘
অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এর ব্যাপারে আগামীকাল রোববার সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শুক্রবার রাতে পতিত স্বৈরাচারের সন্ত্রাসীদের হামলায় কয়েকজন ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হয়েছেন।
একাধিক সূত্র বলছে, সামরিক ও বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। রোববার প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হবে এ বিশেষ অভিযান।