বাণিজ্য নগরী থেকে ধনী জেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু এই শহরের মানুষকে এখনও ছুটতে হয় ঢাকায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক সুবিধা এবং যোগাযোগের সহজলভ্যতা সবকিছুর জন্যেই ঢাকায় ছুটতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দেশের সবচেয়ে ধনী জেলা খেতাব পেয়েও এই জেলায় কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করেননি আওয়ামী জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি জেলা শহর বা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়েও নিজেদের স্বয়ং সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে বড় সমস্যা চিকিৎসা সেবায়। সরকারি বৃহৎ দুটি হাসপাতাল থাকলেও দীর্ঘদিন ইচ্ছাকৃতভাবে হাসপাতাল দুটোকে এক প্রকার পঙ্গু বানিয়ে রাখা হয়েছে। অযত্নে অবহেলায় অকেজো করা হয় মেশিনারিজ। কোনটি চালু থাকলেও নষ্ট কিংবা অপারেটর নেই বলে ফিরিয়ে দেয়া হয় রোগীদের। ডাক্তার আর হাসপাতাল পরিচালকরা সাথে নিয়ে ঘুরেন শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকের দালাল। যার কারণে বাধ্য হয়েই সাধারণ নগরবাসী বাড়তি টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। তবে অধিক টাকা খরচ করেও যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা মিলছে এমন নয়, বরং সেবা পাচ্ছেন খুবই নি¤œমানের। বেসরকারি সেবা ভালো পেতেও ঢাকায় ছুটতে হয় রোগীদের।
নারায়ণগঞ্জে করোনাকালে শেখ হাসিনার মাধ্যমে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ স্থাপন করা হয়। কিন্তু করোনা শেষে এই আইসিইউ নগরবাসীর কোন উপকারে আসে না। বরং লোকবলের অভাবে আইসিইউ বেড থাকা সত্ত্বেও অলস পড়ে আছে হাসপাতালে। সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে আইসিইউ বেড স্থাপন হলেও রোগীদের সেবা নিতে ছুটতে হয় ঢাকার সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর দশার পরে উঠে আসে শিক্ষা খাতের দুর্বল চিত্র। বিপুল পরিমাণ মানুষের এই শহরে স্থাপন হয়নি মান সম্মত স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ রাজধানীর পাশে টাঙ্গাইল, গাজীপুরের মত জেলা শিক্ষায় এগিয়ে গেলেও নারায়ণগঞ্জ পিছিয়ে আছে শুরু থেকেই। এই জেলায় এখনও গড়ে উঠতে পারেনি দেশখ্যাত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তৈরি হয়নি নামকরা কোন কলেজ। বেসরকারি দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও তেমন নামডাক করতে পারেনি তারা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়ে গেছে অধরা।
নারায়ণগঞ্জে একজন মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির এমপিরা ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ১৫ বছর। তারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে নানান আশার বাণী শোনালেও বাস্তবে কোন উদ্যোগই নেননি। বিপরীতে উন্নয়নের মুলা ঝুলিয়ে শুনিয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপনের গল্প। নির্মাণ তো দূরে থাক, ভিত্তি প্রস্থরও স্থাপন করতে পারেনি এককালের দোর্দাণ্ড প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা। অথচ প্রতিনিয়তি নারায়ণগঞ্জকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলতেন মুখের কথায়। উন্নয়নে ছাপিয়ে যেতে চাইতেন মালইয়েশিয়ার আধুনিক শহরগুলোর সাথে।
খেলার মাঠ চিত্ত-বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত খোলামেলা স্থান কিংবা পার্কের ব্যবস্থা করেনি বিগত সরকার। সিটি করপোরেশনে ডা. আইভী কিছু মাঠ, পার্ক ও খোলা স্থান তৈরি করলেও বাকি চারটি নির্বাচনী আসনে কোন পার্ক নির্মাণ হয়নি। উল্টো শহরের সরকারি জমি দখল করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে এই জনপ্রতিনিধিরা। শহরের বালুর মাঠের জায়গা বিক্রি, রেলওয়ের জায়গায় মার্কেট নির্মাণসহ নানানভাবে এই শহরকে বসবাসের অযোগ্য তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে এমপিরা। মুক্ত বাতাস দেয়ার বদলে মানুষকে জলাবদ্ধতা ও দূষিত পরিবেশ উপহার দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
সড়কের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নমানের সড়ক ও ভাঙাচোরা সড়কের দেখা মেলে শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকা ফতুল্লায়। নারায়ণগঞ্জের আর কোন উপজেলায় এমন ভঙ্গুর সড়ক দেখা যায় না। এর বাইরে রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁয়ে গ্রামগঞ্জ ও পৌর এলাকার রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। নব নির্মিত সড়কগুলো দুর্নীতির কারণে ভেঙ্গে পড়ছে দ্রুত সময়ে। মূলত জনপ্রতিনিধিদের বড় অংকের পার্সেন্টিজ দেয়ার পর এসব সড়ক উন্নত করা সম্ভব হয় না ঠিকাদারদের পক্ষে। এভাবেই এক রাস্তা একাধিকবার মেরামত করলেও ভাঙাচোরা থেকেই যায়। আর ডিএনডি এলাকায় বছরের নয় মাস জলাবদ্ধতা থাকে। বৃষ্টি হলে ভোগান্তি বাড়ে কয়েকগুণ।
বাসিন্দারা বলছেন, ধনী জেলা হিসেবে এই শহর নামকরতে পেরেছে এখানকার ব্যবসায়ী ও মানুষের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। মানুষ তাদের কাজের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারলেও এখানকার জনপ্রতিনিধিরা ভূমিকা রেখেছে অত্যাচার, ভোগান্তি ও দুর্নীতিতে। গত ১৫ বছরে জেলার বাসিন্দাদের ন্যূনতম সেবা দেননি তারা। দিতে পারেননি উন্নত মানের চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, উন্নত সড়ক, পার্ক কিছুই না। ১৫ বছর ধরে কেবল দিয়েছেন গাল ভরা বুলি ও অজস্র আশ্বাস।